মালিকুজ্জামান কাকা, যশোর : বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরে কর্ম সংস্থানের দুয়ার খুলে দিয়েছে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। উদ্বোধনের তিন বছরেই পার্কটিতে কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি তরুণ-তরুণীর। এই সংখ্যা অচিরেই ২০,০০০ ছাড়াবে। দক্ষিনাঞ্চলের তরুণ তরুনীরা কর্ম সংস্থানের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় তাকে কর্ম সংস্থানের নতুন দিগন্ত আখ্যা দিয়ে আশাবাদি।
শিল্পায়নে পিছিয়ে থাকা যশোর কর্মসংস্থানে পিছিয়ে পড়েছিল দীর্ঘ দিন। সেরকম ত্রে না থাকায় জেলায় চাকরির বাজারও ছিল মন্দা। আইটি বা তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিা গ্রহণের পর এ জেলার তরুণদের চাকরির জন্য ছুটতে হতো বড় বড় শহরে। এমনকি শিা প্রতিষ্ঠান ছাড়া তাদের অন্য কোথাও চাকরি মিলত না। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। আর এই দিন বদলের সূচনা করেছে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। ফলে প্রযুক্তি শিল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ধারায় যশোর। স্থানীয় তরুণরা স্বপ্ন দেখছেন যশোরে থেকেই সম্ভাবনাময় এক ক্যারিয়ার গড়ার। যশোর শহরের নাজির শঙ্করপুর এলাকায় ১২ একরের কিছু বেশি জমিতে পার্কটি করতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৩১০ কোটি টাকা। তথ্য প্রযুক্তির এই বাণিজ্যিক কেন্দ্রটি এখন আশার বাতিঘর। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক উদ্বোধন করা হয়। এখানে ক্রমান্বয়ে ২০ হাজার মানুষের কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি হবে। যশোর শহরের ডালমিলের উঠতি দীর্ঘ দেহী তরুণ উদিত জামান জানায়, তাকে এখন আর চাকরির চিন্তা মাথায় নিয়ে দিন কাটাতে হয়না। সে যশোর শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে আমার মত অনেকেই এখন নতুন ভবিষ্যতে সম্পৃক্ত হয়েছে। এটি একটি জাতীর অগ্রপথের জন্য প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এখানকার বিনিয়োগকারীরা জানান, সরকার যেসব স্বল্প মেয়াদি প্রশিণ দেয়, তাতে কোনো দ কর্মী তৈরি হয় না। ফলে বেশিরভাগ স্পেস (জায়গা) এখনো খালি রয়েছে। আশানুরূপ বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থান কম তৈরি হয়েছে। তবু এটি ঘিরেই নতুন দিনের সম্ভাবনা আছে যথেষ্ট। অ্যাবাকাস সফট বিডি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির ইকবাল নান্নু বলেন, পিছিয়ে পড়া দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখছে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের কর্মসংস্থানের দুয়ার খুলেছে এটি। তিনি বলেন, এই পার্কে দুই শ্রেণির উদ্যোক্তা রয়েছে। যারা প্রকৃতপে তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে জানেন ও বোঝেন। আর এখানে আরেক দল আছে যারা এটি সর্ম্পকে কিছুই বোঝেন না। যারা প্রকৃত অর্থে এটি সম্পর্কে ভালো জানেন ও বোঝেন তারা কিন্তু ভালো করছেন। আইটি পার্কের একজন কর্মী নাজমুল সাকিব বলেন, আমরা এখানে বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটের সঙ্গে বিভিন্ন আইটি সম্পর্কিত কাজ গুলো করে থাকি। যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের মতো প্রতিষ্ঠান চালু হওয়ায় আমার মতো তরুণ শিার্থী বা যাদের লেখাপড়া শেষ হয়ে গেছে তাদের কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে বা হবে। আমি মনে করি এটি একটি পজিটিভ দিক। এই পার্কের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের দতা বৃদ্ধি করতে পারছি। সেই সঙ্গে কর্ম সংস্থানের মাধ্যমে নিজেরা আত্ম নির্ভশীল হতে পারছি। পার্কটির ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মহিদুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে তুলনামূলক ভাড়া বেশি। এছাড়া আমরা সর্বোচ্চ রেটে বিদ্যুৎ বিল দিয়ে থাকি। এই বিদ্যুৎ বিল কমানোর বা বিলটা বিশেষ শিল্পজোনের আওতায় আনার জন্য পার্ক কর্তৃপকে বার বার জানানো হয়েছে। তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। পার্কে যারা উদ্যোক্তা রয়েছেন দিন দিন তাদের কর্মকান্ড সম্প্রসারিত হচ্ছে। যারা আরও কর্মকান্ড বৃদ্ধি করত চায় সরকার যদি তাদের বিভিন্ন বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে সরকার যে লে পার্কটি নির্মাণ করেছে সেটি দ্রুত বাস্তবায়িত হবে। পার্কে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য কর্তৃপ যদি পণ্যগুলো প্রমোশন করার ব্যবস্থা করে তাহলে নতুন নতুন বিনিয়োগ পাওয়া সহজ হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টেক সিটি। টেক সিটির ব্যবস্থাপক মেজর (অব.) এম ইউ সিকদার জানান, সারাদেশের ৩৯টি হাইটেক পার্কের মধ্যে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কটি রোল মডেল ও পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। এখানকার উদ্যোক্তারা যাতে সফল হতে পারেন সে জন্য সরকার তাদের ব্যাপক সুবিধা দিচ্ছে। তাদের ১৫ বছরের জন্য ট্যাক্স ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিশ্বমানের যেসব সুযোগ-সুবিধা আছে সেগুলোও ভর্তুকি মূল্যে দিচ্ছে। পাশাপাশি মরনব্যাধি করোনার কারণে আইটি বিজনেসে ধাক্কা লাগায় উদ্যোক্তাদের আট মাসের ভাড়া মওকুফ করেছে সরকার। যা রয়েছে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে : যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে রয়েছে ডেটা সংরণের জন্য দেশের দ্বিতীয় সার্ভার স্টেশন। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত প্রথম সার্ভার স্টেশনে কোনও সমস্যা হলে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় ডেটা এখান থেকেই উদ্ধার করা যাবে। যেকোনও সময় যেকোনও প্রয়োজনে এখান থেকেই ডেটা উদ্ধার করা সম্ভব হবে। এখানে রয়েছে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সরবরাহ ব্যবস্থা। পার্কটিতে ফাইবার অপটিক কানেক্টিভিটি রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সাপ্লাইয়ের জন্য ১১ হাজার কেভিএম বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন এবং দুই হাজার কিলোওয়াট মতাসম্পন্ন জেনারেটর স্থাপন করা হচ্ছে। পার্কের মূল ভবনের সামনে পাঁচ একরের একটি বিশাল জলাধার রয়েছে। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পার্কটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশ্য উদ্বোধনের পাঁচ মাস আগে থেকেই এখানে সফটওয়্যার উদ্ভাবন ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। প্রথমে ছয়টি সফটওয়্যার কোম্পানি কার্যক্রম শুরু করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ৩৯টি সফটওয়্যার কোম্পানিকে স্পেস বরাদ্দ দেওয়া হয়। পার্কের প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ছয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ পার্কের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে অনুমোদন চেয়ে ৫৫টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছিল। যাচাই-বাছাই শেষে সেখান থেকে ৩৯টি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দিন দিন এর সংখ্যা বাড়বে। প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, স্টার্টআপ কোম্পানি হিসেবে তরুণদের বিনামূল্যে পুরো একটি ফোর বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। খুলনা বিভাগের ১০ জেলাকে টার্গেট করেই যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। দেশ-বিদেশের আইটি শিল্প উদ্যোক্তারা এখানে বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন। এ পার্কে মূলত সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং, কল সেন্টার, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আর অ্যান্ড ডি) কাজ গুলো সম্পন্ন হবে।
২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোরে একটি বিশ্বমানের আইটি পার্ক স্থাপনের ঘোষণা দেন। এরপর ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যশোরের বেজপাড়া শংকরপুর এলাকায় এই আইটি পার্কের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১২ দশমিক ১৩ একর জমির ওপর আইটি পার্কটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৩০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই হাইটেক পার্কে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। ১৫ তলা এমটিবি ভবন (প্রতিটি ফোরে ১৪ হাজার বর্গফুট হিসেবে দুই লাখ ৩২ হাজার বর্গফুট স্পেস),ফাইভ স্টার মানের ১২ তলা ডরমেটরি ভবন, অত্যাধুনিক কনভেনশন সেন্টারের সঙ্গে রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং ব্যবস্থা। জলাবদ্ধতা নিরসনে রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনেজ ব্যবস্থা। জাপানি উদ্যোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী ডরমেটরি ভবনের ১১ তলার পুরোটা জুড়ে আন্তর্জাতিকমানের জিম স্থাপন করা হয়েছে। সবগুলো ভবন নির্মাণ করা হয়েছে ভূমিকম্প প্রতিরোধক কম্পোজিট (স্টিল ও কংক্রিট) কাঠামো সাপেক্ষে। রাখা হয়েছে ৩৩ কেভি পাওয়ার সাব-স্টেশন, ফাইবার অপটিকাল ইন্টারনেট লাইন এবং অন্যান্য ইউটিলিটি সার্ভিসের সুবিধা। ধারণা করা হচ্ছে, ১২ হাজার লোকের আয়ের উৎস হবে এই পার্ক। ভারত থেকে আনা অপটিকাল ফাইবারের সংযোগ এ পার্ক থেকেই শুরু হয়েছে। ১২ তলা ডরমেটরি ভবনের ছাদে বসানো হয়েছে স্যোলার প্যানেল সিস্টেম। ফলে যে কোন বৈদ্যুতিক গোলযোগে বিকল্প হিসেবে এই স্যোলার প্যানেল ব্যবহার করা হবে। যশোরকে প্রথম ডিজিটাল জেলা ঘোষণা করেছিলেন।তিনি বলেন, বটম আপ পলিসির জন্যই প্রধানমন্ত্রীর যে দর্শন তার জন্য এখন আর তরুণদের ঢাকায় এসে জুতা য় করতে হবে না। এখন যশোরেই প্রযুক্তির ডিজিটাল হাব খুলে দিয়েছেন শেখ হাসিনা সফওয়্যার টেকনোলজি পার্ক তৈরি করা হয়েছে।উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সচিব সুবীর কিশোর চৌধুরী।